১৯ মে ১৯৬১ শিলচর ভাষা আন্দোলন দিবস । বিশ্বে মাতৃভাষা আন্দোলনের অন্যতম রক্তলেখা ইতিহাস
– নিত্যানন্দ সরকার
ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা সাধারণতঃ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকেই বুঝি। একই ভাবে বাঙালি বলতে আমরা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের চিনি। কিন্তু বাংলা ভাষার বিস্তৃতি শুধু বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমান ভাবে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরাতেও বিস্তৃত রয়েছে।
বাংলা ভাষা আন্দোলন ও বরাক উপত্যাকা
১৯৫২ সাল, পশ্চিম পাকিস্তানীদের ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ নীতির বিপরীতে পূর্ব বাংলার (বাংলাদেশ) জনগণ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার দাবীতে যেমন আন্দোলন করে এবং রক্ত দিয়ে দাবী প্রতিষ্ঠা করে; ঠিক তেমনি আসামের বরাক উপত্যাকায়ও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার দাবীতে আন্দোলন এবং রক্ত দিয়ে তা প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল।
আসামের বরাক উপত্যাকায় বাংলা ভাষার আন্দোলন ছিল তদানীন্তন আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ওই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাসী জনগণের প্রতিবাদ।
ঘটনার প্রেক্ষাপট
১৯৬০ সালের এপ্রিল মাস, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে প্রস্তাব ওঠে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার। আর সাথে সাথেই সারা আসাম জুড়ে শুরু হয়ে যায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া এবং বাংলা ভাষাভাসীদের প্রতিবাদ। ফলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ক্রমেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বহু স্থানে অসমীয়া উত্তেজিত জনতা বাঙালি অভিবাসীদের আক্রমণ করতে থাকে এবং ওই বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে উত্তেজনা প্রচণ্ড সহিংসতায় রূপ নেয়। ফলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি বাড়ি-ঘর ফেলে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আর লক্ষাধিক বাঙালি বরাক উপত্যকাসহ উত্তর-পূর্ব অঞ্চলগুলিতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
ওই ঘটনা খতিয়ে দেখতে ন্যায়াধীশ (বিচারপতি) গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়। এই জেলাই (কামরূপ) ছিল সহিংসতার সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা। সেখানে ৯ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয় এবং শতাধিক লোক আহত হয়।
১০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালের সেই সময়ের অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়। এর প্রতিবাদে সারা আসাম জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
বরাক উপত্যকায় প্রতিবাদ আন্দোলন
বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ওপর অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জন্ম হয় ‘কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ’ নামের সংগঠনটির। ওই সংগঠনের ডাকে ১৪ এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে ‘সংকল্প দিবস’ পালন করে। বরাক অঞ্চলের সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার ওই পরিষদ ২৪ এপ্রিল থেকে এক পক্ষকালব্যাপী একটি দীর্ঘ পদযাত্রের ডাক দেন। পদযাত্রাটিতে অংশ নেয়া বাঙালি সত্যাগ্রহীরা (ওই আন্দোলনকারীদের সত্যাগ্রহী বলা হতো) ২৪ এপ্রিল থেকে ২ মে’র মধ্যে প্রায় ২০০ মাইল পথ পায়ে হেটে উপত্যকার গ্রামে গ্রামে প্রচারণা চালিয়েছিলেন।
ওই পদযাত্রা থেকে সংগ্রাম পরিষদের মুখ্যাধিকারী (আহ্বায়ক) সরকারকে ১৩ এপ্রিল ১৯৬১’র মধ্যে বাংলা ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতির আল্টিমেটাম দেন; নইলে ১৯ মে ১৯৬১ সর্বাত্বত হরতাল পালন করা হবে। প্রাদেশিক সরকার ওই বাদী তো মানলেনই না, পক্ষ্যান্তেরে ১২ মে’তে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ দিয়ে শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করলেন। ১৮ মে’তে অসম পুলিশ আন্দোলনের ৩ জন নেতা নলিনীকান্ত, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরীকে (সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক) গ্রেফতার করে।
১৯ মে ১৯৬১’র সর্বাত্বত হরতাল
১৯ মে’র ভোর থেকেই শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেপিং শুরু হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলণকারীরা সরকারী কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট চত্বর ইত্যাদিতে পিকেপিং করে। শিলচরে আন্দোলনকারীরা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ (অহিংস অবস্থান কর্মসূচি) পালন করছিলেন। তাঁদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি বিকেল ৪ টার ট্রেনের সময় পার হওয়ার পর শেষ হওয়ার কথা। আন্দোলনকারীদের সমর্থনে ওই দিন ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনের একটি টিকিটও বিক্রি হয়নি এবং সকালের হরতাল শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়।
বিকালে তারাপুর স্টেশনে (বর্তমানের শিলচর স্টেশন) অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়। একই সময় আড়াইটার দিকে পুলিশ ৯ জন সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করে পুলিশের ট্রাকটি স্টেশনের পাশ দিয়ে রেললাইন পার হচ্ছিল। জানতে পেরে আন্দোলনকারীরা ট্রাকটির গতিরোধ করতে চেষ্টা করে। ভয় পেয়ে পুলিশরা ট্রাক ছেড়ে বন্দিদের নিয়ে পালিয়ে যায় এবং উত্তেজিত জনতা ট্রাকটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই ঘটনার জের ধরে স্টেশনে আগেথেকে মজুদ প্যারামিলিটারী বাকিনী আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই ৯ জন এবং হাসপাতালে নেয়ার পথে আরো ২ জন নিহত হয়, যাঁদের বেশীর্ভাগই ছিলেন মাধ্যমিক শিক্ষার্থী|
শিলচরের ভাষাশহীদরা
শিলচরের বাংলা ভাষা শহীদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শ্রীমতি কমলা ভট্টাচার্য (একমাত্র নারী ভাষা শহীদ), দু’দিন আগে ১৭ মে যার মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। ওই দিন শিলচর স্টেশনে আর যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁরা হলেন তরণী দেবনাথ, কানাইলাল নিয়োগী, শচীন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুনীল সরকার, কুমুদ রঞ্জন দাস, সত্যেন্দ্র দেব, হীতেশ বিশ্বাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস।
রক্তস্নাত বাংলা রাজ্য-ভাষার স্বীকৃতি
শিলচরের হত্যাকাণ্ডের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে পরো বরাক-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। আন্দোলনকারীদের কাছে অবশেষে নতিস্বীকার করে আসাম সরকার। বাংলা ভাষাকে আসামের দ্বিতীয় রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় তাঁরা।

29
Mar