‘এক কাপড়ে এসেছিলাম তার সংসারে, ভেজা কাপড় পরেই থেকেছি, আবার শুকিয়ে গেছে। এভাবে ৫০ বছর পার করেছি, তবু অসুখী ছিলাম না। সংসার জীবনে কোনদিন দু’কথা হয়নি আমাদের। ইদানিং হাতে শাখা পরতাম না, সে বলত কেন শাখা পরো না। তার কি অপরাধ ছিল, সে তো মানুষের বাড়ি ফুল দিয়ে, পূজা করে খেত, আমাদের খাওয়াত। হায়, ভগবান তুমি আমার সিঁদুর কেড়ে নিলে, শাখা কেড়ে নিলে, সাদা কাপড় পরিয়ে দিলে। ওদের কি বিচার হবে না, ভগবান? সকালে সে সাইকেলে বেরিয়েছিল, আহা! আর ফিরল না, কিছুই তো বলে গেল না, যদি জানতাম এভাবে খুন করবে, তাকে কি যেতে দিতাম?’
কথাগুলো শেফালী গাঙ্গুলির। তাঁর স্বামী প্রায় সত্তর বছর বয়সী হিন্দু পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে ঝিনাইদহের প্রত্যন্ত গ্রামে গত ৭ জুন সকালে ছুরিকাঘাত ও গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএস বা ইসলামিক স্টেটস।
প্রায় একই কায়দায় পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুরে শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সৎসঙ্গ সেবাশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পান্ডেকে (৬২) কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গত শুক্রবার (১০ জুন) ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে পাবনা মানসিক হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে এই হত্যাকান্ড ঘটে। ঘটনার সময় নিত্যরঞ্জন প্রাত:ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। দেশের সাম্প্রতিক হত্যাকান্ডের সঙ্গে এই হত্যার মিল দেখছে পুলিশ।
চলতি মাসের ৫তারিখে নাটোরের বনপাড়ায় খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের সদস্য ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজেকে হত্যা করা হয়। তাঁকেও দুর্বৃত্তরা ঘাড়ের পিছনে আঘাত করে। একইদিন চট্টগ্রামে একই কায়দায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে এবং গুলিতে হত্যার শিকার হয়েছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা এসপি (সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ) বাবুল আখতারের স্ত্রী মাহমুদা খানম।
উল্লিখিত চারটি হত্যাকান্ডের মধ্যে তিনটি হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন এদেশে ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা। এবং বাকী একটি হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন পুলিশ সদস্যের স্ত্রী, যিনি ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নারী সদস্য এবং পেশাজীবী হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার স্ত্রী। এই হত্যাকান্ডটি সঙ্গতকারণেই পেশাজীবী হিসেবে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। আবার সরকারেরও ভালো লাগেনি। সাম্প্রতিক হত্যাকান্ডগুলোর জন্যে সরকার ও প্রশাসন মনে করছে, দেশকে অস্থিতিশীল করতে ধর্মীয় উগ্রবাদী তথা জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্যরা এজন্যে দায়ী। এই পুলিশ কর্মকর্তা -বাবুল আখতার এই জঙ্গী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযান পরিচালনা করে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। একারণে তাঁর স্ত্রীকে জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্যরা নিশানা করেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে যেভাবেই বলা হোক না কেন, সাম্প্রতিককালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর আক্রমণ বাড়ছে। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, শারীরিকভাবে আক্রমণ, ভীতি প্রদর্শন প্রভৃতি ঘটনা ঘটেই চলেছে। দেশের ১৪টি পত্রিকার প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত মাসে (মে ২০১৬) সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর মোট কমপক্ষে ৮৩টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ১৪টি ছিল হত্যাকান্ড। এর আগের মাস এপ্রিলে হামলার ঘটনা ছিল কমপক্ষে ৫৮টি। এ সময়ে ১০ জন নিহত হয়েছেন। অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এমন মরদেহ উদ্ধার হয়েছে ৬টি। আহত হয়েছেন ৮৭জন। অপহরণের শিকার হয়েছেন ১জন। নিখোঁজ হয়েছেন ৫ জন। একটি পরিবারকে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এপ্রিলে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩ জন সংখ্যালঘু নারী, তার মধ্যে ২জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, দখল ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ২৭টি।
পুলিশের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ১৮ মাসে রাজধানী ঢাকাতেই জঙ্গি সংশ্লিষ্ট হামলার ১২টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২১ জন। যাঁদের মধ্যে পুলিশ, ব্লগার, লেখক, প্রকাশক রয়েছেন। দিনাজপুরে ৯টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন দুজন। পাবনায় দুটি ঘটনায় নিহত হয়েছেন একজন। রংপুরে জাপানি নাগরিক ও মাজারের খাদেমকে হত্যা করা হয়েছে। নাটোরে খুন হয়েছেন খ্রিস্টান দোকানি, রাজশাহীতে শিক্ষকসহ দুজন, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলাসহ তিন ঘটনায় নিহত হয়েছেন পাঁচজন। নীলফামারীতে তিন ঘটনায় নিহত ২, পঞ্চগড়ে পুরোহিত হত্যা, কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, চট্টগ্রামে পীরের মুরিদ, পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী ও শিক্ষকসহ পাঁচজন খুনের শিকার হয়েছেন। ঝিনাইদহে খুন হয়েছেন মন্দিরের পুরোহিত ও ধর্মান্তরিত ব্যক্তি। টাঙ্গাইলে ধর্ম অবমাননায় অভিযুক্ত দর্জি, বান্দরবানে বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ, কুষ্টিয়ায় বাউলভক্ত ও সিলেটে ব্লগার খুন হয়েছেন। ফরিদপুরে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। এসব ঘটনায় রাজনৈতিকভাবে নানা আলোচনা হলেও পুলিশ ঘটনার পরপরই জোরালোভাবে বলছে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কথা। হত্যার ধরনসহ নানা বিষয়ে মিল থাকায় এসব উগ্রবাদী চক্রের কাজ বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ ঘটনাতেই পুলিশ রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়েছে। খুনিরা থেকে গেছে অধরা। এ অবস্থায় আতঙ্ক ক্রমেই বাড়ছে। ইতিমধ্যে ব্লগারসহ ভিন্নমতের অনেকেই নিরাপত্তাহীনতায় দেশ ছেড়েছেন। দেশান্তরি হয়েছে বেশ কিছু ধর্মীয় সংখ্যালঘু।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে কেন এমনটি ঘটছে। যে দেশে সকল নাগরিকের সমান অধিকার এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতাসীন; সেই সময়ে এই আক্রমণগুলো কেন বাড়ছে। আর আক্রমণের ঘটনা ঘটলেও কেন তার প্রতিকার হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, হামলাকারীদের সম্পর্কে তথ্য সরকারের হাতে আছে; তবে কেন সেই হামলাকারীদের দমন করা যাচ্ছে না? জঙ্গীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিযান চালানোর ঘোষণা দেওয়ার পরই ১০ জুন সকালে পাবনায় খুনের ঘটনাটি কি হত্যাকারী চক্রটি রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানালো?
২.
সাধারণভাবে নির্বাচনের আগে বা পরে সংখ্যালঘু বিশেষত: হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর আক্রমণ করার ঘটনা আমাদের দেশে একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আর সাম্প্রতিক সময়ের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছে। সেক্ষেত্রে সাম্প্রতিকালের হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন আপাত: নিরীহ কিছু মানুষ। যা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ভীতি-আতঙ্ক এবং নিরাপত্তাহীনতা আরও বেশী সংক্রমিত হয়েছে। অবশ্য, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা বেশ আগে থেকেই নিরাপত্তাহীনতার ঘূর্ণাবর্তে আটকে আছে। একারণে হামলা-নির্যাতনের কারণে তারা স্থান ত্যাগ (মাইগ্রেশন) করে, যা একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এই স্থান ত্যাগের ঘটনাটি শুরু সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। যখন ধর্মের ভিত্তিতে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতকে দুই ভাগে ভাগ করে দু’টি স্বাধীন দেশে রূপান্তরিত করা হ’ল। সাধারণভাবে হিন্দুদের দেশ হিন্দুস্তান এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দেশ পাকিস্তান তৈরি হ’ল। সেই পাকিস্তান আবার পূর্ব ও পশ্চিমের দুটি অংশের মানুষকে শুধুমাত্র ধর্মের পরিচয়কে ধারণ করে গড়ে ওঠে। পাকিস্তানের পূর্ব অংশের হিন্দুরা বিশেষত: ধনী হিন্দুরা, যারা সমাজে নেতৃত্ব দিতো, সেই অংশ তখুনি হিন্দুস্তানে পাড়ি জমায়। হিন্দুস্তানের অনেক মুসলিম সদস্যও পাকিস্তানের পূর্ব অংশে চলে আসেন।
প্রকৃতপক্ষে, উনিশ শতকের ব্রিটিশ ভারতে জাতি-চেতনা গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তবে তা প্রকাশিত হয় হিন্দু ও মুসলিম ধর্মমতকে ঘিরে। যে কারণে এই উপমহাদেশে আজও সাম্প্রদায়িকতা বিষয়টি খুবই প্রবলভাবে বিদ্যমান। বহুভাষীর দেশ আজকের ভারতে এখনও একটি জাতিগত বোধ গড়ে ওঠেনি; যদিও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে তারা ধর্মনিরপেক্ষ। তেমনি ধনী, অভিজাত অ-বঙ্গভাষী মুসলিমদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানেও ধর্মই ছিল জাতীয়তার কেন্দ্রবিন্দুতে। ধর্মীয় পরিচয়ে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও পূর্ব বঙ্গ অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের বাংলাভাষী মুসলিমদের পাকিস্তানী অভিজাত মুসলিমরা খুবই নীচু চোখে দেখতো। এ কারণে পূর্ববঙ্গবাসীদের সাচ্চা মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পাকিস্তানী শাসকেরা বাংলাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেয়। যা বাংলার মানুষেরা মেনে নিতে পারেনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই (১৯৪৮ সন) পাকিস্তানী শাসকদের এই পদক্ষেপ প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে। আর পাঁচ বছরের মধ্যে ১৯৫২ সালে সর্বস্তরের পূর্ববঙ্গবাসীদের বিরোধিতার রূপ হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি সৃষ্টি হয়। যাতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার এক অভূতপূর্ব জমিন তৈরি হয়।
ভাষার ওপর আক্রমণ এবং অর্থনীতি ও প্রশাসনের প্রায় সকল ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকায় মুসলিম লীগের ওপর থেকে পূর্ববঙ্গবাসীদের মোহভঙ্গ ঘটে। যার তাৎক্ষণিক ফল হিসেবে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে জনতা বয়কট করে; আস্থা রাখে যুক্তফ্রন্টের ওপর। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকেরা জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে নির্বাচিত আইন সভা, মন্ত্রী সভা ভেঙ্গে গভর্ণর-এর শাসন চালু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৫ সালের মে মাসে সামরিক শাসন জারি করা হয়। পূর্ববঙ্গবাসীরা তখন উর্দুভাষী-বিত্তশালী-নিয়ন্ত্রক পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে নিজের স্বাতন্ত্র্য নির্ধারণ করে। শুরু হয় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী লড়াই। এতে নেতৃত্ব দেয় আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা মুসলিম গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। বলাইবাহুল্য, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গে দশ শতাংশের মত হিন্দু ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বাস হলেও সম্প্রদায়গত বিভেদ থেকেই যায়। জাতি গঠনের জন্যে রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি যে ধরণের সাংস্কৃতিক-মনোজাগতিক লড়াইয়ের প্রয়োজন ছিল, তার চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণ-নিপীড়ন-ঠকানো অর্থাৎ বৈষম্য, না পাওয়ার বেদনাটি বেশী বেশী করে উচ্চারিত হয়। এটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে খুব বেশী আস্থা তৈরি করেনি; অমুসলিমরা মনে করেছে ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের (পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের) লড়াই হচ্ছে। জাতীয়তাবাদী লড়াই শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র লড়াইয়ে পরিণত হয়ে ১৯৭১এ বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন ভূ-খন্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে দিয়ে ১৯৪৭এর ধর্মভিত্তিক পরিচয় পিছনে ফেলে জাতীয়তাবাদী পরিচয় এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে। তবে ওই জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম এমনি এক জাত্যভিমানে রূপ নেয়, যেখানে বাঙালি ছাড়া আর কোন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় আনা হয়নি। আর যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে একটি দেশ অর্জনের সংগ্রামকে ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা বিরোধিতা করেছিল, সেই গোষ্ঠীর আপাত: পরাজয় ঘটলেও সমাজ থেকে তাদেরকে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে পরাজিত করার কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা চেতনাগতভাবে ধর্মীয় পরিচয়কে যেমন উর্ধে¦ তুলে ধরে, তেমনি ভারত বিরোধিতাকে জোরেশোরে আওড়ায়। অবশ্য, সাতচল্লিশোত্তরকাল থেকেই অভিজাত, উর্দুভাষী মুসলিমদের পক্ষ নেয়া পূর্ব বঙ্গের ধনী-ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ধ্বজাধারী এই গোষ্ঠীটি ভারত বিরোধিতা করতে থাকে; যা ভারত বিরোধিতার নামে হিন্দু বিরোধিতা হয়ে দাঁড়ায়। আর বস্তুগতভাবে হিন্দু প্রতিবেশীর সম্পত্তি দখলে নিতে পারলে যে নগদ লাভ, তা এই বিরোধিতার মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যেখানে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে একটি সাধারণ নীতিমালা গ্রহণ ও চর্চা করা উচিত ছিল, সেখানে পকিস্তানী আমলের ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ নাম বদলে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ হিসেবে বহাল রেখে রাষ্ট্র একটি ভেদ-চেতনাকে উসকে দেয় ও লালন করে। এবং এই আইনের খাঁড়ায় এদেশের প্রধান দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে দখলদার ও উচ্ছেদ হওয়ার সংস্কৃতিকে প্রকারান্তরে উৎসাহিত করে। যদিও ১৯৭২এর ৪ নবেম্বর গৃহীত সংবিধানে প্রস্তাবনা শিরোণামের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদগণকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’ কার্যত: ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সকল ধর্মকে সমানভাবে উৎসাহিত করার নীতি গ্রহণ করা হয়। অথচ প্রয়োজন ছিল, সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত জাতি-চেতনা গড়ে তুলতে জাতীয়তাবাদের পরিপূরক সংস্কৃতি ধারণ-লালন ও চর্চা করা।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে আপাত: পরাস্ত হওয়া সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীটি ১৯৭৫এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যার মধ্যে দিয়ে তাদের হারানো রাজনৈতিক জমিনটি আবারও ফিরে পায়। ওই গোষ্ঠী কারাভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে অনুমোদন দেয়া হয়। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে অর্জিত সংবিধানকে বিসর্জন দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আরেক সেনাশাসক ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে। ভারতে বাবরি মসজিদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৯০এ সেই সময়ের স্বৈরাচারী সরকার টিকে থাকার কৌশল হিসেবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটাতে উৎসাহিত করে। এসবের অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায় সুফী প্রভাবিত ধর্মীয় সহনশীলতার এই সমতল ভূমিতে ক্রমান্বয়ে ধর্মান্ধতা প্রকটভাবে জায়গা করে নিয়েছে।
যেহেতু সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা একাত্তরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা এবং ভারতের মিত্র হওয়ায় তাদের সমর্থক হিসেবে আবির্ভূত হয়; সেহেতু একাত্তরের বিরোধিতাকারীদের কাছে আওয়ামী লীগ, ভারত এবং হিন্দু বিরোধিতা এক ও অভিন্ন হয়ে দাঁড়ায়। একারণে নির্বাচনের কালে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত তোপের মুখে পড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষগুলো। আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দল হিসেবে দাবি করলেও তারা কিন্তু সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষগুলোকে সুরক্ষায় তেমন কিছু করতে পারেনি; আবার তাদের দলের অনেক সদস্যই সংখ্যালঘু দমন-পীড়নের সাথেও যুক্ত।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে (২০০১ সালে) এদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। ওই সময়ে বলা হয়, নির্বাচনে জয়ী বিএনপি ও জামায়াতের জোট সমর্থকরা আওয়ামী লীগ সমর্থক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ করেছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ওই ঘটনায় কোন পদক্ষেপ নেয়নি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে আবারও ধর্মনিরপেক্ষতা পুন:স্থাপিত হয়, তবে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম বহাল রেখেছে। এই সময়ে সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিশেষ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে বিচার করা।
এই প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক জোট। তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকের ওপর যেমন পড়েছে, তেমনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপরও আক্রমণ করেছে; পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে। কিছুদিন বিরতির পর আবারও তা বিদেশী নাগরিক হত্যা ও বেছে বেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরীহ সদস্যদের হত্যার মধ্যে দিয়ে খুবই ভয়ঙ্করভাবে দেখা দিয়েছে।
সম্প্রদায়গত নিপীড়নের সাথে অর্থনৈতিক বৈষম্য খুবই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী এই চার দশকের বেশী সময়ে আমাদের বেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে। আমাদের জাতীয় আয় বেড়েছে। প্রযুক্তির দিক দিয়ে আমরা অনেক এগিয়ে। পাশাপাশি ধন-বৈষম্যও অনেক বেড়েছে। এখন কোটিপতির সংখ্যা ২২ পরিবার নয়, বাইশ হাজারেরও বেশী পরিবার। চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে ৩৫ শতাংশ মানুষের বাস। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে বেশ। পোষাকে-আশাকে আমাদের আধুনিকতা চোখ ধাঁধানোর মত, তবে মস্তিষ্কে অন্ধত্ব, পশ্চাদপদতা এখনও জায়গা নিয়ে আছে। বিজ্ঞানের সকল সুবিধা আমরা ভোগ করলেও মানসিকভাবে আমরা আজও বিজ্ঞানমনষ্ক হতে পারিনি। যে কারণে সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধি আমাদেরকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করে; তেমনি দখলÑলুণ্ঠনের সংস্কৃতি আমাদের বৈশিষ্ট্য। আমাদের দেশের বিকাশমান কর্পোরেট পুঁজি তার লুণ্ঠনের চরিত্র সগর্বে লালন করে চলেছে; আর রাষ্ট্র তা সযতেœ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে। লুণ্ঠন শুধুমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, রাষ্ট্রের সম্পত্তি তথা সাধারণের সম্পত্তি (কমোন প্রোপার্টি)ও আজ নির্বিচারে লুণ্ঠিত হচ্ছে। এখানে সংখ্যালঘু যেমন নিপীড়িত, তেমনি সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রান্তিক মানুষেরাও অত্যাচারিত, বিতাড়িত হচ্ছে। আর রাষ্ট্র একচেটিয়া পুঁজির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সবসময়ই নির্যাতক, পীড়ক ও দখলদারের পক্ষ নিচ্ছে।
৩.
সাম্প্রতিককালের ধারাবাহিক হত্যা-নির্যাতনের ঘটনাগুলো দেখে একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনাগুলো ঘটিয়ে চলেছে। যারা এটি করছে, তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। বিশেষত: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের হত্যা করে আইএস হত্যার দায় স্বীকার করছে; যদিও এই দায় স্বীকারের বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে এটি পরিষ্কার যে, আন্তর্জাতিক একটি গোষ্ঠী আমাদের দেশে আইএস জঙ্গির উপস্থিতি প্রমাণে মরিয়া।
তবে বিস্ময়কর হচ্ছে, সরকার এই জঙ্গি বা খুনী গোষ্ঠীকে দমন করতে পারছে না। হত্যার মত জঘন্য অপরাধ করেও খুনীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। যে কোন ঘটনার পিছনে সরকার যেমন বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করছে; তেমনি বিএনপিও প্রতিটি ঘটনার জন্যে সরকারকে দায়ী করছে। এই পারষ্পরিক দোষারোপ পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে। তবে শাসকদের দায়-দায়িত্ব সব সময় বেশী, সেকারণে সরকারের উচিত অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি বিধান করা।
মনে রাখতে হবে, কোন একটি দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন বজায় রেখে সেই জাতি-রাষ্ট্র সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে এগুতে পারে না। #
গৌরাঙ্গ নন্দী
জুন ১২, ২০১৬
13
Jun